
Fig: একটি গ্রামীণ জঙ্গল মহল গ্রামের ঐতিহ্যবাহী কাঁচা মাটির বাড়ি এবং হাতে চাপা কুয়া। এই অঞ্চলের অবকাঠামো এখনও প্রায়ই মৌলিক পর্যায়েই রয়ে গেছে, যা দীর্ঘদিনের পশ্চাৎপদতার প্রতিফলন।
পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গল মহল অঞ্চল—যার মধ্যে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম এবং (পশ্চিম) মেদিনীপুরের কিছু অংশের বনাঞ্চল অন্তর্ভুক্ত—রাজ্যের অন্যতম সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এলাকা। “জঙ্গল মহল” (শব্দার্থে, বনভূমি) শব্দটির উৎপত্তি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে, যখন এই ঘন বন ও আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহকে আলাদাভাবে শিথিলভাবে শাসিত জেলা হিসেবে পরিচালনা করা হতো। বর্তমানে, এই নামটি পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্তবর্তী (ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশার সংলগ্ন) একটি ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক অঞ্চলকে বোঝায়, যেখানে বন এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের আধিপত্য রয়েছে। এই অঞ্চলের জনসংখ্যার আনুমানিক ৩০–৪০% তফসিলি উপজাতিভুক্ত (যেমন সাঁওতাল, মুন্ডা, ভূমিজ প্রভৃতি), যা পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
এলাকাটি ছোটনাগপুর মালভূমির অংশ, যার বৈশিষ্ট্য হল ঢেউখেলানো ভূমি, লাল ল্যাটেরাইট মাটি এবং বর্ষা-নির্ভর কৃষি। পূর্ব পশ্চিমবঙ্গের উর্বর গঙ্গা বদ্বীপের তুলনায়, জঙ্গল মহলের জলবায়ু আধা-শুষ্ক এবং এখানে প্রায়ই খরা দেখা যায়; অধিকাংশ অঞ্চল শাল ও সেগুনের বন দ্বারা আচ্ছাদিত। জটিল ভৌগোলিক পরিস্থিতি, উচ্চ আদিবাসী জনসংখ্যা এবং ঐতিহাসিক বিচ্ছিন্নতার এই সংমিশ্রণ জঙ্গল মহলে দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্যের সৃষ্টি করেছে—যা কলকাতা এবং বঙ্গ বদ্বীপের আপেক্ষিক সমৃদ্ধির সঙ্গে একটি প্রকট বৈপরিত্য গড়ে তোলে।
জঙ্গল মহলে দারিদ্র্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
জঙ্গল মহলের পশ্চাৎপদতার শিকড় গভীরভাবে ইতিহাসে প্রোথিত। ব্রিটিশ শাসনামলে “জঙ্গল মহলস” জেলা (যা তৎকালীন পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ নিয়ে গঠিত ছিল) অবকাঠামো ও শিক্ষার ক্ষেত্রে চরম অবহেলার শিকার হয়। স্বাধীনতা লাভের পরও এই জেলাগুলি রাষ্ট্রের নীতিগত অগ্রাধিকারের বাইরে থেকে যায়; শিল্পায়ন ছিল অত্যন্ত সীমিত এবং সেচের সুযোগও ছিল অত্যন্ত অপ্রতুল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, পুরুলিয়া জেলা ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং পরে পশ্চিমবঙ্গে সংযুক্ত হয়—ততদিনে এই অঞ্চল উন্নয়ন ও সাক্ষরতার দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে। এখানকার সামাজিক গঠন—বৃহৎ আদিবাসী কৃষক ও নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠী—এমন ছিল যে, ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী এই অঞ্চলের মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রায় কোনো বিনিয়োগ করেনি। ফলে, কয়েক দশক ধরে দারিদ্র্য এখানে গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসে, যা চরমপন্থী আন্দোলনের জন্য এক উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জঙ্গল মহলে বিচ্ছিন্নভাবে নকশাল (মাওবাদী) কার্যকলাপ দেখা যায়, যা ২০০০-এর দশকে পূর্ণমাত্রার মাওবাদী বিদ্রোহে রূপ নেয়। ২০০৮ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে, জঙ্গল মহলের কিছু অঞ্চল—বিশেষত পশ্চিম মেদিনীপুরের লালগড়—“মাওবাদী ঘাঁটি” হিসেবে কুখ্যাতি লাভ করে, যেখানে বিদ্রোহীরা স্থানীয় অসন্তোষকে পুঁজি করে নিজেদের অবস্থান মজবুত করে তোলে।
বিদ্রোহের ফলে রাজ্যের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষ, সরকারি পরিষেবার ব্যাঘাত এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আরও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়। এই অশান্তির মূল কারণ ছিল মূলত আদিবাসী জনগণের “পিছিয়ে পড়া এবং ঐতিহাসিক বঞ্চনা”, পাশাপাশি তাদের সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি ও ভূমি অধিকারের দাবি। এর প্রতিক্রিয়ায়, ২০১০–২০১১ সালে সরকারের কড়া নিরাপত্তা অভিযান সহিংসতা দমন করলেও, এই ঘটনা জঙ্গল মহলে দারিদ্র্য ও সামাজিক-রাজনৈতিক প্রান্তিকতার গভীর সংযোগকে স্পষ্ট করে তোলে।
২০১১ সালের পর শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গল মহলকে মূলধারার উন্নয়নের আওতায় আনার জন্য একযোগে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। তবুও, ঐতিহাসিক অবহেলা ও সংঘর্ষের ক্ষতচিহ্নের কারণে জঙ্গল মহলে দারিদ্র্য পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি এবং দীর্ঘস্থায়ী রয়ে গেছে। পরবর্তী অংশগুলোতে অঞ্চলের বর্তমান সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রোফাইল, দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্যের কারণ এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গৃহীত উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রোফাইল: দারিদ্র্য ও উন্নয়নের সূচক
সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি উন্নতির পথে থাকলেও, প্রায় প্রতিটি সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচকে জঙ্গল মহল পিছিয়ে রয়েছে। মূল সূচকগুলো এই অঞ্চলের বঞ্চনার মাত্রা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে:
দারিদ্র্যের হার: বিশ্বব্যাংকের এক মূল্যায়ন অনুযায়ী, ২০১২ সালে জঙ্গল মহলের (যেমন পুরুলিয়া জেলা) প্রায় ৩১-৩৮% জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, যা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সর্বাধিক (রাজ্য গড় প্রায় ২০%)। সাম্প্রতিক মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইনডেক্স (এমপিআই) অনুযায়ী পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও, দারিদ্র্যের মাত্রা এখনও উদ্বেগজনকভাবে বেশি—২০১৯-২১ সালে পুরুলিয়ায় প্রায় ২৬.৮% মানুষ বহু মাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছিল, যা রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি; তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক হার ছিল প্রায় ১১.৯%। অপরদিকে, শহর কলকাতার এমপিআই দারিদ্র্যের হার ছিল মাত্র প্রায় ২.৬%। এই ব্যবধানটি জঙ্গল মহলকে গভীরভাবে প্রোথিত দারিদ্র্যের একটি ব্যতিক্রমী অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করে।
আয় ও জীবিকা: এখানকার অর্থনীতি প্রধানত কৃষিনির্ভর এবং জীবিকা নির্বাহমূলক। পুরুলিয়ার কর্মজীবী জনগণের ৬০% এরও বেশি কৃষিকাজে (চাষি বা কৃষিশ্রমিক হিসেবে) নিয়োজিত, এবং একই চিত্র দেখা যায় বাঁকুড়া ও ঝাড়গ্রাম জেলাতেও। জমির পরিমাণ ছোট এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বৃষ্টিনির্ভর; উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরিবার ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক। কৃষি ছাড়া অন্য কোনো কাজের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত; ফলে এসব জেলায় মাথাপিছু আয় পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সর্বনিম্নদের মধ্যে পড়ে (জেলার নির্দিষ্ট আয়ের তথ্য খুব বেশি নেই, তবে ভোগব্যয় এবং সম্পত্তির মালিকানার মতো সূচক রাজ্য গড়ের তুলনায় অনেক পিছিয়ে)। নগর বা খনি অঞ্চলে (ঝাড়খণ্ড ও আসানসোল অঞ্চলে) মৌসুমী শ্রমের জন্য অভিবাসন সাধারণ ঘটনা, কারণ মানুষ তাদের সামান্য কৃষি আয়ের পরিপূরক হিসেবে অনানুষ্ঠানিক কাজ খোঁজেন। পুরুলিয়ায় সাম্প্রতিক এক মাঠ পর্যবেক্ষণ গবেষণায় গবেষকরা উল্লেখ করেছেন, “এখানকার বেশিরভাগ মানুষই হাতেমৌত জীবনযাপন করেন” এবং অনিশ্চিত জীবিকার ওপর নির্ভরশীল।
সাক্ষরতা ও শিক্ষা: জঙ্গল মহলের সাক্ষরতার হার রাজ্য গড়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। ২০১১ সালের জনগণনায় পুরুলিয়ার সাক্ষরতার হার ছিল ৬৫.৪% (নারী সাক্ষরতা মাত্র ৫০.৫%), যা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন। বাঁকুড়া (৭০.৩%) এবং তৎকালীন পশ্চিম মেদিনীপুর (৭৮%) তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভালো অবস্থানে ছিল, তবে ঝাড়গ্রাম মহকুমার মতো কিছু অঞ্চলে হার ছিল আরও কম। তুলনামূলকভাবে, ২০১১ সালে রাজ্যজুড়ে সাক্ষরতার হার ছিল প্রায় ৭৭%। এই নিম্ন শিক্ষা অর্জনের পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিকভাবে বিদ্যালয়ে কম বিনিয়োগ এবং স্থায়ী সামাজিক কারণ—অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার হার বেশি, বিশেষ করে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া লক্ষ্য করা যায় (যেমন, পুরুলিয়ার কিছু ব্লকে নারী সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৩০–৪০%)। যদিও রাজ্য সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি (যেমন, কন্যাশ্রী স্কলারশিপ) চালু করেছে, তবুও এসব দূরবর্তী গ্রামে শিক্ষাগত পরিকাঠামো (বিদ্যালয়, শিক্ষক, হোস্টেল ইত্যাদি) এখনও অপর্যাপ্ত।
স্বাস্থ্য ও পুষ্টি: স্বাস্থ্য সূচকগুলোও একইভাবে উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে। স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সীমিত—জেলা শহরের বাইরে হাসপাতালের সংখ্যা খুবই কম, এবং গ্রামগুলো সাধারণত অল্পসংখ্যক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল। শিশুপুষ্টিহীনতা এখানে মহামারী আকারে বিরাজমান। ২০২৩ সালে গ্রামীণ পুরুলিয়ায় করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫–১০ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ৭৪% অপুষ্টিতে ভুগছে—যা জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক বেশি। এই জেলাগুলোতে শিশুমৃত্যু এবং মাতৃমৃত্যুর হার পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অংশের তুলনায় বেশি (যদিও সরকারি ভাবে জেলা ভিত্তিক হার সবসময় প্রকাশিত হয় না, বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় ফলাফল আরও খারাপ)। নিরাপদ পানীয় জল এবং স্যানিটেশনের অভাব দীর্ঘদিনের সমস্যা, যা বিভিন্ন রোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও সরকারি তথ্য অনুযায়ী কিছু অগ্রগতি হয়েছে (যেমন, স্বচ্ছ ভারত মিশনের আওতায় উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ কমেছে এবং টিকাদান হার বেড়েছে), তবুও সামগ্রিক স্বাস্থ্য সূচক এখনও পিছিয়ে রয়েছে। অধিকাংশ গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সাথে সংযোগ ব্যবস্থা দুর্বল, এবং এই গ্রামীণ/জঙ্গল এলাকায় কাজ করতে ইচ্ছুক চিকিৎসকেরও অভাব রয়েছে।
অবকাঠামো: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু উন্নতি হলেও, জঙ্গলমহলে মৌলিক অবকাঠামো এখনও খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, ২০১১ সালের তথ্য অনুযায়ী, পুরুলিয়া I ব্লকের মাত্র ১৯% গ্রামে পাকা রাস্তা ছিল এবং মাত্র ৩৩% গ্রামে কোনো ধরনের পরিবহন সংযোগ (যেমন বাস বা রেল) ছিল। বিদ্যুৎ প্রায় সকল গ্রামে (১০০%) পৌঁছেছে, তবে বিদ্যুৎ সরবরাহের মান ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। পানীয় জল (প্রতি গ্রামে হ্যান্ড পাম্প, টিউবওয়েল) সহজলভ্য হলেও, নিরাপদ ও পরিশোধিত জলের অভাব রয়েছে এবং খরার সময় জল সংকট দেখা দেয়। আর্থিক অবকাঠামোও অত্যন্ত সীমিত—উক্ত ব্লকে মাত্র ~৫.৭% গ্রামে কোনো ব্যাংক ছিল, যা দেখায় কতটা বিচ্ছিন্ন অনেক সম্প্রদায় আনুষ্ঠানিক ঋণ ও ব্যাংকিং পরিষেবা থেকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে মোবাইল ফোনের প্রসারের ফলে (২০১১ সালে ৮০% গ্রামে কোনো না কোনোভাবে ফোন সংযোগ ছিল, আজকের দিনে মোবাইল নেটওয়ার্কের কারণে তা আরও বেড়েছে), যা বিচ্ছিন্নতা কিছুটা কমিয়েছে। তা সত্ত্বেও, তুলনামূলকভাবে উন্নত জেলাগুলোর তুলনায়, জঙ্গলমহলের রাস্তা, সেচ, বাজার ও জনপরিসেবা এখনও যথেষ্ট অনুন্নত, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
সারসংক্ষেপে, জঙ্গলমহলের সামাজিক-অর্থনৈতিক চিত্র হলো—নিম্ন আয়, কৃষিনির্ভরতা, কম সাক্ষরতার হার (বিশেষত নারীদের মধ্যে), দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং অবকাঠামোগত ঘাটতি। এই সূচকগুলি প্রমাণ করে যে, জঙ্গলমহল শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, ভারতের বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতেও একটি উন্নয়ন-বঞ্চিত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ব্যাকওয়ার্ড রিজিয়ন্স গ্রান্ট ফান্ড’ (BRGF) পশ্চিমবঙ্গের ১১টি জেলা—যার মধ্যে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুর অন্তর্ভুক্ত—পিছিয়ে পড়া জেলা হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং অতিরিক্ত সম্পদ বরাদ্দ করেছে। জঙ্গলমহলের এই স্থায়ী ঘাটতির পেছনে একাধিক আন্তঃসংযুক্ত কারণ রয়েছে, যা পরবর্তী অংশে আলোচনা করা হয়েছে।
জঙ্গলমহলে স্থায়ী দারিদ্র্যের কারণসমূহ
জঙ্গলমহল অঞ্চলে দারিদ্র্য দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পেছনে একাধিক কাঠামোগত কারণ রয়েছে:
উপজাতি এবং ঐতিহাসিক প্রান্তিকতা:
জঙ্গলমহলের জনসংখ্যা ও শ্রমশক্তির মূল ভিত্তি গঠিত হয়েছে আদিবাসী (উপজাতি) সম্প্রদায়ের দ্বারা। ঐতিহাসিকভাবে, তারা সামাজিকভাবে বঞ্চিত ছিল এবং ঔপনিবেশিক ও স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রাথমিক উন্নয়ন কর্মসূচিগুলির দ্বারা অনেকাংশেই উপেক্ষিত হয়েছে। ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বাধা মূলস্রোতের শিক্ষা ও বাজার ব্যবস্থার সাথে তাদের সংযুক্তিকে কমিয়ে দেয়। এই অঞ্চলের অনেক উপজাতির (যেমন সাঁওতাল, লোধা ইত্যাদি) নিজস্ব ভাষা/উপভাষা রয়েছে; বাংলা (বা ইংরেজি) ভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাদের জন্য উপযোগী হয়নি, ফলে অশিক্ষার হার ছিল অত্যন্ত বেশি।
তদুপরি, উপজাতি গোষ্ঠীগুলোর ভূমি-অধিকার দুর্বল ছিল—ভূমি থেকে বঞ্চিত হওয়া ছিল সাধারণ ঘটনা, বহিরাগত বা উচ্চবর্ণের লোকেরা উর্বর জমি অধিগ্রহণ করত এবং উপজাতিরা বনাঞ্চলের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হতো। সম্পদ ও কণ্ঠস্বরের অভাবে এই সম্প্রদায়গুলি দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকে ছিল। আজও ভারতে তফসিলভুক্ত উপজাতি (ST) জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের হার অনান্যদের তুলনায় দ্বিগুণ, যা জঙ্গলমহলেও স্পষ্টভাবে দেখা যায়। সামাজিক প্রান্তিকতার কারণে গত কয়েক দশক পর্যন্ত তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাও সীমিত ছিল; ফলে উন্নয়ন তহবিল কার্যকরভাবে নিচুতলার মানুষের কাছে পৌঁছায়নি।
বন-ভিত্তিক জীবিকার উপর নির্ভরশীলতা:
নাম অনুযায়ী, জঙ্গলমহল বনভূমিতে আচ্ছাদিত এবং এখানকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের জীবিকা বন-নির্ভর। অনেক গ্রামীণ পরিবার ছোটখাটো বনজ দ্রব্য সংগ্রহ (পাতার থালা তৈরির জন্য শালপাতা, বিড়ি তৈরির জন্য কেন্ডুপাতা, জ্বালানি কাঠ, ফল, ওষধি গাছপালা ইত্যাদি) এবং ছোট আকারের বন-ভিত্তিক কাজে নির্ভরশীল। যদিও বন কিছুটা নিরাপত্তা জাল সরবরাহ করে, এসব কর্মকাণ্ড থেকে আয় খুবই কম এবং তা মৌসুমি। তদুপরি, বন সংরক্ষণ আইন অনেক সময় ঐতিহ্যগত অধিকার সীমিত করে দেয়। জঙ্গলমহলে কৃষিকাজও বন-বাস্তুতন্ত্রের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত—এখানে অধিকাংশ চাষাবাদ বনের সীমানা ঘেঁষা উঁচু জমিতে, বৃষ্টিনির্ভর এবং এক ফসলী (সাধারণত ধান, শস্য) হয়, যার ফলন খুব কম। ঘন ঘন খরা ও মাটির ক্ষয় কৃষিজ দারিদ্র্য আরও বাড়িয়ে তোলে। সেচের আওতা খুবই সীমিত (যেমন পুরুলিয়ায় মাত্র ১৫-২০% জমিতে সেচ সুবিধা আছে), ফলে কৃষকরা পুরোপুরি বর্ষার উপর নির্ভরশীল। মূলত, ভঙ্গুর প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা—বিকল্প শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অভাবে—আয়কে অস্থির ও কম রাখে। বন উজাড় ও জলবায়ু পরিবর্তন এই জীবিকার ভিত্তিকে আরও সংকুচিত করেছে, যা পরিবেশগত পরিবর্তনের পর্যবেক্ষকদের মন্তব্যে উঠে এসেছে।
ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ও দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা:
ভূপ্রকৃতি এবং ঐতিহাসিক অবহেলার কারণে এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা সবসময়ই চ্যালেঞ্জের মুখে। সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত, জঙ্গলমহলের অনেক গ্রাম প্রকৃত অর্থেই “গ্রিডের বাইরে” ছিল—পাকা রাস্তা থেকে অনেক দূরে, পরিবহন ব্যবস্থাও ছিল অত্যন্ত সীমিত। এই বিচ্ছিন্নতা বাজারে (পণ্য বিক্রি বা কাজের সন্ধানে), শিক্ষায় (শিশুদের নিকটতম স্কুলে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে হয়), এবং স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি সরকারি পরিষেবা ও কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিও দুর্গম বনগ্রামগুলোতে পৌঁছাতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে। যদিও অবকাঠামো ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে, তবুও ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা এখানকার মানুষদের অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিকাশকেন্দ্র থেকে আলাদা রেখে দারিদ্র্যের চক্রকে আরও শক্তিশালী করছে।
সংঘাত ও শাসন ব্যবস্থার ঘাটতি:
২০০০-এর দশকে জঙ্গলমহলে ছড়িয়ে পড়া মাওবাদী বিদ্রোহ ছিল দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্যের sowohl লক্ষণ, তেমনি কারণ। বছরের পর বছর ধরে চলা সংঘাত জীবিকা বিপর্যস্ত করেছে এবং মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে; নিরাপত্তাজনিত কারণে উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলোও স্থবির হয়ে পড়েছিল। বিদ্রোহের চূড়ান্ত সময়ে কিছু এলাকায় সরকারের উপস্থিতি সাময়িকভাবে হ্রাস পেয়েছিল, যার ফলে শাসন ব্যবস্থায় শূন্যতা সৃষ্টি হয়।
সক্রিয় সংঘাতের বাইরেও জঙ্গলমহল দুর্বল শাসন ব্যবস্থার শিকার—কঠিন পরিবেশে কাজ করতে রাজি এমন সরকারি কর্মকর্তার সংখ্যা কম, স্থানীয় উন্নয়ন তহবিলে দুর্নীতি, এবং আদিবাসী জনগণ ও প্রশাসনের মধ্যে আস্থার অভাব বিদ্যমান। বিদ্রোহীরা প্রকৃত অসন্তোষ (জমি সংক্রান্ত সমস্যা, পুলিশের নির্যাতন, কর্মসংস্থানের অভাব) কাজে লাগিয়ে স্থানীয়দের সংগঠিত করেছে, যার ফলে পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাজ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সামরিকীকৃত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
মোট ফলাফল ছিল, প্রায় এক দশক ধরে প্রকৃত উন্নয়ন কার্যত উপেক্ষিত হয়েছে। পশ্চাদপদতা ও বিদ্রোহ একে অপরকে উৎসাহিত করেছে: এক গবেষণা প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, “মাওবাদী আন্দোলনের উত্থান… অঞ্চলের বঞ্চনার উপর ভিত্তি করে একটি নতুন সামাজিক-রাজনৈতিক মাত্রা সৃষ্টি করেছে।” যদিও ২০১১–২০১২ সালের মধ্যে বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল, তার পরিণতিতে একটি আতঙ্কগ্রস্ত জনসংখ্যা থেকে গেছে, যারা বহিরাগতদের প্রতি সন্দিহান এবং এখনও উন্নয়নের সুফলের অপেক্ষায়। শান্তি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা দেখিয়েছে যে, জঙ্গলমহলে দারিদ্র্য বিমোচন কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং একটি রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তাও।
নিম্নমানব উন্নয়ন ও সামাজিক সমস্যা:
অর্থনীতির বাইরে, এই অঞ্চলে উচ্চ মাত্রার নিরক্ষরতা, শিশু বিবাহ এবং কুসংস্কারের মতো সামাজিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা গভীর দারিদ্র্যের সাথে প্রায়ই যুক্ত থাকে। অপুষ্টি ও স্থানীয় রোগ (যেমন, বনাঞ্চলে ম্যালেরিয়া) এর মতো স্বাস্থ্য সমস্যা উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয় এবং দুর্দশা দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে। লিঙ্গ বৈষম্য স্পষ্ট—জঙ্গলমহলের নারীরা জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ, কৃষিকাজের মতো ভারী দায়িত্ব বহন করেন, কিন্তু শিক্ষা বা বেতনের চাকরিতে তাঁদের সুযোগ সীমিত, যা পারিবারিক কল্যাণেও প্রভাব ফেলে। এই মানব উন্নয়নের ঘাটতিগুলো দারিদ্র্যের কারণ এবং ফলাফল উভয়ই, ফলে একটি দুষ্ট চক্র সৃষ্টি হয়েছে।
সারসংক্ষেপে, জঙ্গলমহলের দারিদ্র্য বহুস্তরীয় এবং আত্মবর্ধনশীল। জমি ও বননির্ভরতা কম আয় দেয়; মূলত আদিবাসী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুঁজি ও প্রভাবের অভাব রয়েছে; ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা এবং সংঘাতের ইতিহাস উন্নয়নমূলক উদ্যোগে বাধা সৃষ্টি করেছে। এই চক্র ভাঙতে হলে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি, যা আমরা পরবর্তী অংশে আলোচনা করব।
সরকারি ও বেসরকারি হস্তক্ষেপ: কর্মসূচি ও প্রভাব
গত এক দশকে, জঙ্গলমহলের বিশেষ চাহিদা অনুধাবন করে, সরকার (রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে) এবং বেসরকারি সংস্থাগুলি বিভিন্ন ধরনের হস্তক্ষেপমূলক কর্মসূচি চালু করেছে। এখানে আমরা প্রধান প্রধান উদ্যোগের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং তাদের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করছি:
টার্গেটেড সরকারি উন্নয়ন প্যাকেজ: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার সশস্ত্র আন্দোলনের অবসানের (প্রায় ২০১১–২০১২) পর “জঙ্গলমহল উন্নয়ন প্যাকেজ” ঘোষণা করে। এর আওতায় সকল আদিবাসী পরিবারের জন্য ভর্তুকিযুক্ত চাল (কেজি প্রতি ₹২ দরে) বিতরণ, স্থানীয় যুবকদের পুলিশ ও গ্রাম সুরক্ষা বাহিনীতে নিয়োগ, গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ, এবং বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের পরিকাঠামো সম্প্রসারণের মতো কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিকে জোরদার করা হয়। অঞ্চলটিকে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সংযুক্ত করতে বিশেষ মেলা ও প্রচারমূলক কর্মসূচি (যেমন “জঙ্গলমহল উৎসব”) আয়োজন করা হয়। এসব উদ্যোগের ফলে মৌলিক সুযোগ-সুবিধার উন্নতি হয়েছে (উদাহরণস্বরূপ, গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন ও সড়কের ঘনত্ব বেড়েছে), তবে দীর্ঘমেয়াদী দারিদ্র্য দূরীকরণে এর প্রভাব মিশ্র। মৌলিক নিরাপত্তা ও আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু সমালোচকরা মনে করেন, অনেক হস্তক্ষেপ ছিল “উপরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া” এবং বাস্তবায়নে ফাঁকফোকর রয়ে গেছে।
রোজগার সৃষ্টি ও জীবিকা সংক্রান্ত প্রকল্প: জঙ্গলমহলে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন (MGNREGA) একটি জীবনরেখা হিসেবে কাজ করছে, হাজার হাজার পরিবারকে অকুশলী শ্রমিকের কাজ (সড়ক নির্মাণ, সেচ পুকুর, বনায়ন) সরবরাহ করছে। অন্যান্য চাকরির অভাবে, এই অঞ্চলে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে MGNREGA-র সর্বাধিক কর্মদিবসের সংখ্যা নিয়মিতভাবে রিপোর্ট করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৭ সালে “উষরমুক্তি” নামে একটি বৃহৎ জনমুখী প্রকল্প শুরু হয়, যেখানে MGNREGA তহবিল ব্যবহার করে জঙ্গলমহলে জলাধার উন্নয়নের কাজ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য স্থানীয় নদী পুনরুজ্জীবিত করা, সেচ পরিকাঠামো গড়ে তোলা এবং পতিত উঁচু জমিকে উৎপাদনশীল কৃষিজমিতে রূপান্তর করা—যা পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের ৬টি জেলার ৫৫টি ব্লককে অন্তর্ভুক্ত করছে।
এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে ৪ লক্ষ হেক্টর জমি সংস্কার করা হচ্ছে এবং ৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচের ব্যবস্থা হয়েছে, যার ফলে আনুমানিক ৫ লক্ষ গ্রামীণ পরিবার উপকৃত হচ্ছে। প্রাথমিক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, উষরমুক্তি ও অনুরূপ প্রকল্পগুলি কিছু গ্রামে জল সরবরাহ ও ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে, যা দেখায় যে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কঠিন কৃষি-জলবায়ুগত পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব। এছাড়াও, পশ্চিমবঙ্গের “ভারত জোড়ো” (গ্রামীণ সড়ক সংযোগ) কর্মসূচি এবং কেন্দ্রীয় প্রকল্প যেমন প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা (গৃহনির্মাণ) আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, যার ফলে দরিদ্র মানুষের জন্য সংযোগ ও আবাসনের মান উন্নত হয়েছে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উদ্যোগ: মানব উন্নয়নের সমস্যাগুলি মোকাবিলার জন্য সরকার ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আদিবাসী শিশুদের জন্য আবাসিক বিদ্যালয় খুলেছে (যেমন—কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থায়নে আদিবাসী এলাকার জন্য একলব্য মডেল আবাসিক বিদ্যালয়)। রাজ্যের মুখ্য প্রকল্প ‘কন্যাশ্রী প্রকাল্প’ (স্কুলে মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করতে নগদ অর্থ প্রদান) এমনকি পুরুলিয়া জেলার মতো এলাকাতেও মেয়েদের স্কুলে ভর্তি বাড়িয়েছে বলে জানা গেছে। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে, কিছু প্রত্যন্ত ব্লকে মোবাইল মেডিক্যাল ইউনিট ও টেলিমেডিসিন কেন্দ্র চালু হয়েছে এবং গ্রামীণ এলাকায় চিকিৎসকদের নিয়োগে উৎসাহভাতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রামকৃষ্ণ মিশন ও ভারত সেবাশ্রম সংঘের মতো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি জঙ্গলমহলের বিভিন্ন অংশে দাতব্য বিদ্যালয়, হোস্টেল ও স্বাস্থ্য শিবির পরিচালনা করছে।
এইসব প্রচেষ্টার ফলে কিছু উন্নতি হয়েছে (যেমন—পুরুলিয়ায় টিকাকরণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এনএফএইচএস জরিপ অনুযায়ী হাসপাতালে শিশুর জন্মের হার বেড়েছে), তবে এখনও কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে। অনেক আদিবাসী স্কুলে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত এখনও খারাপ এবং দক্ষ চিকিৎসা কর্মীদের ধরে রাখা একটি চ্যালেঞ্জ। সামগ্রিকভাবে, সামাজিক খাতে এই ধরনের হস্তক্ষেপ ধীরে ধীরে বঞ্চনা কমাচ্ছে, তবে আরও ব্যাপকভাবে এই উদ্যোগগুলি বাড়ানোর প্রয়োজন।
সমাজকে ক্ষমতায়ন ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রকল্প: জঙ্গলমহল অঞ্চলে বহুদিন ধরেই বিভিন্ন তৃণমূল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা জীবিকার বৈচিত্র্যকরণ ও সমাজকে ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রদান (Professional Assistance for Development Action) সংস্থা এই অঞ্চলে মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী (SHG) গড়ে তোলার পাশাপাশি তসর রেশম চাষ, বাড়ির পোলট্রি, ছাগল পালন এবং ক্ষুদ্র উদ্যোগের জন্য মাইক্রো-ক্রেডিটের মতো নতুন কার্যকলাপের মাধ্যমে জীবিকা উন্নয়নে কাজ করছে। বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ফেডারেশন ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে, যার ফলে মহিলারা সঞ্চয় ও ঋণের সুযোগ পাওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাতেও নিজেদের মত প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম পেয়েছেন। কিছু সফলতার মধ্যে রয়েছে SHG সদস্যদের দ্বারা ল্যাক ও তসর সিল্ক পণ্য বিপণন, বা সমবায় ভিত্তিতে পোলট্রি খামার পরিচালনা, যা গৃহস্থালি আয়ে কিছুটা হলেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা – যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি সরকার (BRLF – ভারত রুরাল লাইভলিহুডস ফাউন্ডেশন) এর সঙ্গে অংশীদারিত্বে জলাধার প্রকল্প, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ও কৃষি-বনায়ন চালু করেছে, যাতে কৃষিকাজ আরও টেকসই ও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে সক্ষম হয়।
কৃষি-সহযোগিতা ও কৃষক ক্লাব গঠিত হয়েছে, যাতে কৃষকদের উন্নত প্রযুক্তি (যেমন খরারোধী ফসলের জাত) সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। যদিও এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত কর্মসূচিগুলি সাধারণত সীমিত পরিসরে (এক সময়ে কয়েকটি গ্রাম জুড়ে) পরিচালিত হয়, তবুও এগুলি অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নের কার্যকর মডেল প্রদর্শন করে। যেখানে স্থানীয় জনগণ পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করে (যেমন, উষরমুক্তির অধীনে নিজেদের গ্রাম উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করা), সেখানে ফলাফল সাধারণত আরও ভালো এবং টেকসই হয়।
নিরাপত্তা ও শাসন সংস্কার: বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বহু নতুন পুলিশ স্টেশন ও নিরাপত্তা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে, যাতে মাওবাদীরা পুনরায় আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে – এর ফলে উন্নয়নমূলক কাজ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাবোধ বৃদ্ধি পেয়েছে। শাসন সংস্কারের মধ্যে রয়েছে স্থানীয় ভাষায় দক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ, পুলিশ ও প্রশাসকদের জন্য আদিবাসী সংস্কার বিষয়ে সংবেদনশীলতা প্রশিক্ষণ, এবং পঞ্চায়েতে দুর্নীতি রোধে প্রচেষ্টা। আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপস্থিতি বেড়েছে (যেমন, পঞ্চায়েত ও রাজ্য বিধানসভায় সংরক্ষিত আসনগুলি এসটি প্রার্থীদের দ্বারা পূরণ হচ্ছে), যা স্থানীয় সমস্যাগুলির কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে সহায়ক। এসব পদক্ষেপ, যদিও আরও প্রাতিষ্ঠানিক, তবুও নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ যে উন্নয়নমূলক কর্মসূচিগুলি প্রকৃতপক্ষে দরিদ্রদের কাছে পৌঁছে যায়। প্রমাণ রয়েছে যে ২০১২ সালের পর, জঙ্গল মহল এলাকায় স্থিতিশীলতা আসার পর অবকাঠামোগত প্রকল্প ও কল্যাণ প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, কর্মকর্তারা জানান, বয়স্ক ভাতা, গ্রামীণ গ্রন্থাগার ইত্যাদি কর্মসূচিতে অনেক বেশি নাম নিবন্ধন হয়েছে, কারণ পূর্বে “নো-গো” হিসেবে চিহ্নিত এলাকাগুলোতেও এখন পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
পর্যটন ও সাংস্কৃতিক উদ্যোগ: উন্নয়নের একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে সরকার জঙ্গল মহলকে সংঘাতপূর্ণ পশ্চাদপদ অঞ্চল থেকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পুনরায় ব্র্যান্ড করার চেষ্টা করছে। এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (আদিবাসী নৃত্য, সঙ্গীত, উৎসব) ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য (জঙ্গল, পাহাড়, নদী) কাজে লাগানো হচ্ছে। ২০১৬–১৭ সালে শুরু হওয়া একটি পর্যটন সার্কিট প্রকল্পের আওতায় ঝাড়গ্রাম ও আশেপাশের এলাকায় পর্যটন পরিকাঠামো যেমন লজ, কেবল কার, এবং ঐতিহ্যবাহী হোম-স্টে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পর্যটন সুবিধা নির্মাণ ও এই খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রায় ₹৬৫ কোটি বরাদ্দ করা হয়। সম্প্রতি ২০২৪ সালে, মুখ্যমন্ত্রী আদিবাসী হোম-স্টে-কে সহায়তা করার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন—আদিবাসী পরিবারগুলোকে প্রশিক্ষণ ও অর্থায়নের মাধ্যমে অতিথি-নিবাস পরিচালনায় সক্ষম করে তুলতে, যাতে পর্যটন আয়ের সরাসরি উপকারভোগী হন স্থানীয়রা। রাজ্য সরকার লক্ষ্য করেছে, জঙ্গল মহলে যেসব রিসোর্ট গড়ে উঠছে, তার অনেকগুলোই বহিরাগতদের মালিকানাধীন, তাই আদিবাসী উদ্যোক্তাদের ক্ষমতায়নে নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এসব উদ্যোগ জঙ্গল মহলের সমৃদ্ধ আদিবাসী সংস্কৃতি ও পরিবেশকে প্রতিবন্ধক নয়, বরং সম্পদ হিসেবে কাজে লাগাতে চায়। যদিও এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, এসব উদ্যোগ টেকসই উন্নয়নের দিকে একটি পরিবর্তন নির্দেশ করে—যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে ইকো-ট্যুরিজম ও সাংস্কৃতিক পর্যটন স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বাইরে চলে যাওয়া রোধ এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে গর্ব জাগিয়ে তুলতে পারে। এর কার্যকারিতা নির্ভর করবে প্রশিক্ষণ, বিপণন, শান্তি ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার ওপর।
সামগ্রিকভাবে, জঙ্গল মহলে নেওয়া বিভিন্ন হস্তক্ষেপ পরিসংখ্যানগত দিক থেকে ইতিবাচক ফলাফল দেখাতে শুরু করেছে—২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পুরুলিয়ায় দারিদ্র্যের হার (এমপিআই অনুযায়ী) প্রায় ৫০% থেকে কমে ~২৭% হয়েছে, সাক্ষরতা ও স্বাস্থ্য সূচক কিছুটা উন্নতি হয়েছে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি ধীরে ধীরে কমছে। তবে, গুণগত মান এবং টেকসইতার ক্ষেত্রে এখনও গুরুতর চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনেক কর্মসূচিই খাপছাড়া বাস্তবায়নের কারণে কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ, এমজিএনআরইজিএ স্বল্পমেয়াদি স্বস্তি দিলেও টেকসই সম্পদ সৃষ্টি করতে সব সময় সক্ষম হয়নি; শিক্ষা কার্যক্রমে ভর্তি বাড়লেও শেখার ফলাফল এখনও কম। পরবর্তী অংশে, এই ফলাফলগুলিকে আরও প্রসঙ্গভিত্তিকভাবে বোঝাতে জঙ্গল মহলের অগ্রগতির তুলনা অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে করা হয়েছে।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ: জঙ্গল মহল বনাম অন্যান্য অঞ্চলসমূহ
জঙ্গল মহলের উন্নয়ন সূচকগুলি পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অংশ এবং ভারতের অনুরূপ অঞ্চলের সঙ্গে তুলনা করলে স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে।
পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে: জঙ্গল মহল (দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গ) এমন একটি ব্যতিক্রম, যেখানে রাজ্যের অন্যান্য অংশে উল্লেখযোগ্য দারিদ্র্য হ্রাস ঘটেছে। যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে, পুরুলিয়ার বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার (২০১৯-২১ সালে ২৬.৮%) রাজ্যের গড় (১১.৯%)-এর চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ছিল। অন্যান্য জঙ্গল মহল জেলার মধ্যে বাঁকুড়া (১৮.৫%) এবং পশ্চিম মেদিনীপুর (১৮.১%)-এর দারিদ্র্যের হারও গড়ের চেয়ে বেশি ছিল—অন্যদিকে উত্তর ২৪ পরগনা বা কলকাতা মতো সমৃদ্ধ জেলাগুলিতে দারিদ্র্যের হার ৫%-এরও নিচে ছিল। এই বৈষম্য সাক্ষরতা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও বিদ্যমান: উদাহরণস্বরূপ, কলকাতার সাক্ষরতার হার ৮৬% ছাড়িয়ে গেছে এবং এখানে স্বাস্থ্যসেবা অনেক উন্নত, যেখানে পুরুলিয়া ৬৫% সাক্ষরতার হার এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য সংগ্রাম করছে। এমনকি গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেও, জঙ্গল মহল এবং উত্তরবঙ্গের কিছু অংশ (দিনাজপুর অঞ্চল) মানব উন্নয়ন সূচকে ধারাবাহিকভাবে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন (এইচডিআর) এবং পরবর্তী আপডেটগুলিতে, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়াকে সর্বনিম্ন মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই) মানের জেলা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, যেখানে গঙ্গা ডেল্টার জেলাগুলি (যেমন হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর) অনেক উপরের স্থানে রয়েছে। এর একটি প্রধান কারণ হচ্ছে কৃষি: ডেল্টা অঞ্চলে উর্বর মাটি এবং বহু-ফসলি চাষ (লাভজনক নগদ ফসলসহ) থেকে উপকার পাওয়া যায়, অন্যদিকে জঙ্গল মহলে একমাত্র ফসলভিত্তিক, বৃষ্টিনির্ভর কৃষি থেকে আয় অনেক কম। শিল্পক্ষেত্রেও, জঙ্গল মহলে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান খুবই কম (কিছু সীমান্তবর্তী অঞ্চলে খনন ছাড়া), যা বৃহত্তর কলকাতা শিল্পাঞ্চলের মতো নয়। ফলে, রাজ্যের অভ্যন্তরীণ তুলনা দুটি ভিন্ন বাংলার চিত্র তুলে ধরে— আপেক্ষিকভাবে উন্নত শহুরে/সমুদ্রতটবর্তী অঞ্চল বনাম বঞ্চিত পশ্চিমাঞ্চলীয় আদিবাসী অঞ্চল।
ভারতের অন্যান্য আদিবাসী অঞ্চলের সঙ্গে তুলনা: জঙ্গল মহলের চ্যালেঞ্জগুলো একান্তই তার নিজস্ব নয়—এগুলো মধ্য ও পূর্ব ভারতের বিস্তৃত “আদিবাসী বেল্ট”-এর পরিস্থিতির প্রতিফলন। ঝাড়খণ্ডের মতো সংলগ্ন রাজ্য, ওড়িশার কিছু অংশ (যেমন কোরাপুট, কালাহান্ডি), ছত্তিশগড় (বস্তার), অথবা মধ্যপ্রদেশ (বুন্দেলখণ্ড) অঞ্চলে একই ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়: উচ্চ আদিবাসী জনসংখ্যা, বনাচ্ছাদিত পাহাড়ি ভূপ্রকৃতি, ঐতিহাসিক অবহেলা, এবং প্রায়শই অতীতে বা বর্তমানে বামপন্থী বিদ্রোহের উপস্থিতি। এসব এলাকায় একইভাবে নিম্ন সাক্ষরতার হার, উচ্চ শিশুমৃত্যু হার এবং উচ্চ দারিদ্র্যের হার লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, পার্শ্ববর্তী ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দারিদ্র্যের হার (এমপিআই) ২০১৫–১৬ সালে ছিল প্রায় ৩২%—যা তখনকার পুরুলিয়ার ৪৯.৭% এর তুলনায় কিছুটা কম, তবে এখনও জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি। ভারতের অনেক আদিবাসী জেলা “আস্পিরেশনাল ডিস্ট্রিক্টস” কর্মসূচির অংশ (যদিও পশ্চিমবঙ্গ সম্পূর্ণভাবে সেই উদ্যোগে অংশগ্রহণ করেনি, তবুও এখানকার চাহিদার সঙ্গে এর মিল রয়েছে)।
ইতিবাচক দিক থেকে বলা যায়, যেখানে লক্ষ্যভিত্তিক হস্তক্ষেপ করা হয়েছে—যেমন ওড়িশার আদিবাসী শিক্ষাবাস বা কেরালার আদিবাসী স্বাস্থ্য উদ্যোগ—সেখানে ফলাফল উন্নত হয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে জঙ্গল মহল অন্যান্য অঞ্চলের সেরা অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। সাংস্কৃতিকভাবে, জঙ্গল মহলের আদিবাসীদের ঝাড়খণ্ডের সিংভূম বা ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ অঞ্চলের আদিবাসীদের সঙ্গে আত্মীয়তা রয়েছে, এবং সীমান্তবর্তী এই মিল থাকার কারণে সমাধানগুলোও এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে প্রয়োগযোগ্য হতে পারে (যেমন বনাধিকার বাস্তবায়ন, ক্ষুদ্র বনজ দ্রব্য বিপণন সমিতি ইত্যাদি)। অনাদিবাসী গ্রামীণ দারিদ্র্যের তুলনায়, আদিবাসী অঞ্চলে দারিদ্র্য সাধারণত আরও গভীর, উপরে আলোচিত কারণগুলোর জন্য। তাই, জঙ্গল মহল ভারতের এই সামগ্রিক উন্নয়ন চ্যালেঞ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন নিশ্চিত করা বড় লক্ষ্য।
রাজনৈতিক ও সামাজিক পার্থক্য: একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো, পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গল মহল, তার দারিদ্র্য সত্ত্বেও, ঐতিহাসিকভাবে তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী মানব উন্নয়নমূলক গুরুত্বসম্পন্ন একটি রাজ্যে অবস্থিত (যেমন ১৯৭০-এর দশকের ভূমি সংস্কার, পঞ্চায়েত রাজ প্রতিষ্ঠান)। এটি, উদাহরণস্বরূপ, কিছু মধ্যভারতের রাজ্যের তুলনায় আলাদা, যেখানে শাসনব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে দুর্বল। জঙ্গল মহলে হস্তক্ষেপের কার্যকারিতা পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক পরিকাঠামো ও নাগরিক সমাজের কারণে লাভবান হতে পারে, যা কিছু পার্শ্ববর্তী রাজ্যের তুলনায় বেশি শক্তিশালী। তবে, রাজনৈতিকভাবে জঙ্গল মহল ভিন্ন পথে চলেছে: এই অঞ্চলের অসন্তোষ মাঝে মাঝে রাজনৈতিক পরিবর্তনে রূপান্তরিত হয়েছে (উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক নির্বাচনে জঙ্গল মহল এলাকার ভোট বিরোধী দলের দিকে গেছে, যা চলমান হতাশার প্রতিফলন)। এই গতিশীলতা যেকোনো ক্ষমতাসীন সরকারকে উন্নয়নের বকেয়া কাজ আরও আন্তরিকভাবে সমাধানের জন্য চাপ সৃষ্টি করে।
মূলত, জঙ্গল মহলের অভিজ্ঞতা আঞ্চলিক বৈষম্যের বৃহত্তর সমস্যাটিকে তুলে ধরে। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এটি একটি দরিদ্রতার পকেট, যা দীর্ঘমেয়াদি ও বিশেষ মনোযোগ দাবি করে; ভারতের প্রেক্ষাপটে এটি বহু আদিবাসী-প্রধান অঞ্চলের দুরবস্থার প্রতিচ্ছবি। তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, সাধারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রয়োজনীয় হলেও তা যথেষ্ট নয়—স্থানীয় প্রেক্ষাপটে উপযোগী লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ (আদিবাসী সংস্কৃতি, বনভিত্তিক অর্থনীতি, সংঘাত নিরসন) বৈষম্য দূরীকরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি ও সুপারিশ
জঙ্গল মহলের দারিদ্র্য মোকাবিলা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা। বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আগ্রহী নীতিনির্ধারক, উন্নয়নকর্মী এবং গবেষকদের জন্য কয়েকটি কৌশলগত সুপারিশ উঠে এসেছে:
সমন্বিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন:
জীবিকা নির্বাহের জন্য শুধুমাত্র জীবিকানির্ভর কৃষির বাইরে বিকল্প আয়ের পথ খুঁজে বের করার প্রয়োজন রয়েছে। কৃষিভিত্তিক শিল্প (যেমন খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বাঁশের হস্তশিল্প, তসর রেশম উৎপাদন) এবং ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তোলা স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। জঙ্গল মহলে গ্রামীণ শিল্পকেন্দ্র বা ফুড পার্ক স্থাপন, যেখানে ব্যবসায়ীদের স্থানীয় যুবকদের (বিশেষ করে আদিবাসী) নিয়োগ ও প্রশিক্ষণে উৎসাহ দেওয়া হবে, তা সহায়ক হবে।
কাঠের কাজ, রাজমিস্ত্রি, যন্ত্রপাতি মেরামত ইত্যাদি পেশায় দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি আরও বিস্তৃত করা উচিত, যাতে বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জঙ্গল মহলের শ্রমশক্তি আরও বেশি উপার্জনক্ষম কর্মসংস্থান পেতে পারে। কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—ক্ষুদ্র লিফট সেচ, চেক ড্যাম এবং পুরুলিয়ার তুরগা পাম্পড স্টোরেজ প্রকল্পের মতো উদ্যোগ সম্পন্ন করে সেচ সম্প্রসারণ করা জরুরি।
জলবায়ু সহনশীল ফসল এবং উন্নত কৃষি প্রযুক্তি (সম্ভব হলে স্থানীয় সম্প্রদায় থেকে বাছাই করা কৃষি সম্প্রসারণকর্মীদের মাধ্যমে) প্রবর্তন করলে খরার প্রভাব কমানো সম্ভব হবে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে শক্তিশালীকরণ:
মানবসম্পদ উন্নয়নকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে সরবরাহ ও চাহিদা—দুই দিকেই জোর দেওয়া প্রয়োজন: সহজে পৌঁছানো যায় এমন স্থানে আরও বেশি স্কুল (বিশেষত মাধ্যমিক বিদ্যালয়), উন্নত সুবিধা (হোস্টেল, শৌচাগার, বিদ্যুৎ) এবং স্থানীয় আদিবাসী ভাষাভাষী শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে ভাষাগত ব্যবধান কমানো জরুরি। আদিবাসী এলাকায় সাংস্কৃতিকভাবে প্রাসঙ্গিক পাঠ্যক্রম ও প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতা অভিযানও সামগ্রিক সাক্ষরতার পরিবেশ উন্নত করতে পারে।
স্বাস্থ্য খাতে, স্থানীয় সম্প্রদায় থেকে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত শক্তিশালী প্রাথমিক স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে (যাতে অপুষ্টি, মাতৃস্বাস্থ্য, ম্যালেরিয়ার মতো সমস্যার সমাধান করা যায়) এবং এতে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য হবে। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে গ্রামের ক্লিনিকগুলোকে শহরের ডাক্তারদের সঙ্গে সংযুক্ত করা যেতে পারে।
এ ছাড়াও, পুষ্টি-নির্দিষ্ট উদ্যোগ—যেমন বাড়ির আঙিনায় সবজিবাগান, পরিপূরক খাদ্য কর্মসূচি, স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত খাদ্য দিয়ে বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিল—শিশুদের অপুষ্টি মোকাবিলায় আরও জোরদার করা উচিত, কারণ এখানকার শিশুদের অপুষ্টির হার এখনও উদ্বেগজনকভাবে বেশি।
পরিষ্কার পানীয় জল (ক্ষুদ্র পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ) ও স্যানিটেশন খাতে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে রোগের বোঝা কমে। এই সামাজিক বিনিয়োগগুলির ফল পেতে সময় লাগলেও, দারিদ্র্যের চক্র ভাঙতে এগুলির সুফল অত্যন্ত বেশি।
আদিবাসী সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন:
যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনায় উপকারভোগীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা আবশ্যক। স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠানসমূহ (গ্রাম পরিষদ) যেন প্রকৃতপক্ষে আদিবাসী কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্ব করে, তা নিশ্চিত করা হলে কর্মসূচিগুলো আরও জবাবদিহিমূলক হবে। বনাধিকার আইন (FRA) দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত—আদিবাসী পরিবারগুলিকে ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহৃত বনভূমির বৈধ মালিকানা প্রদান তাদের জীবিকা নিরাপদ করবে এবং সংঘাত কমাবে।
বনজ সম্পদের (সমবায় বা বন ধন বিকাশ কেন্দ্রের মাধ্যমে) সম্প্রদায়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা মহুয়া, শালপাতা, তেঁতুল ইত্যাদি পণ্যের ন্যায্য মূল্য আদায়ে আদিবাসীদের সহায়তা করতে পারে।
এছাড়া, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, উৎসব এবং বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে আদিবাসী সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও প্রচার করলে আত্মসম্মানবোধ ও সামাজিক সংহতি গড়ে উঠবে।
যখন কোনো সম্প্রদায় সম্মানিত ও শোনা বোধ করে, তখন তারা উন্নয়নমূলক উদ্যোগে আরও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। জঙ্গল মহলে অতীতের অনেক সমস্যার মূল কারণ ছিল বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি; তাই, আদিবাসীদের কেবল উপকারভোগী নয়, বরং অংশীদার হিসেবে ক্ষমতায়িত করার অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গিই এখানে মূল চাবিকাঠি।
নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারে অব্যাহত গুরুত্বারোপ:
শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য পূর্বশর্ত। যদিও মাওবাদী বিদ্রোহ এখন অনেকটাই স্তিমিত, তবুও চরমপন্থীরা যেন অব্যাহত অসন্তোষকে কাজে লাগাতে না পারে, সে জন্য সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। এর অর্থ কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা নয়, ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করা—যেমন, মুলতুবি থাকা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, পুলিশ ও বন বিভাগের কর্মকর্তারা যেন স্থানীয় বাসিন্দাদের ন্যায্যভাবে আচরণ করেন তা নিশ্চিত করা, এবং যেকোনো মানবাধিকার সংক্রান্ত অভিযোগ দ্রুত সমাধান করা।
যদি জনগণ দেখে যে রাষ্ট্র ন্যায়পরায়ণ ও সাড়া দিচ্ছে, তবে সহিংস আন্দোলনের প্রতি আকর্ষণ কমে যায়।
প্রাক্তন মাওবাদী কর্মী ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসন ও কাউন্সেলিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যেতে পারে, যাতে সংঘাতের ক্ষত সম্পূর্ণভাবে নিরাময় হয়।মূলত, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নকে একসাথে এগিয়ে নিতে হবে। সরকার সম্প্রতি যে কৌশল গ্রহণ করেছে—স্থানীয় সমস্যাগুলি চিহ্নিত ও সমাধানের জন্য উন্নয়ন দল মোতায়েন—তা সঠিক পথে একটি পদক্ষেপ, এবং এ ধরনের উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া উচিত।
পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা:
জঙ্গল মহলে বিভিন্ন হস্তক্ষেপের প্রভাব নিয়ে একাডেমিক ও নীতিগত গবেষণাকে উৎসাহিত করা উচিত। একটি স্থানীয় উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (সম্ভব হলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা এনজিওদের সহযোগিতায়) প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যা বাস্তব সময়ে বিভিন্ন সূচক পর্যবেক্ষণ করে নীতিনির্ধারকদেরকে কোন উদ্যোগ কার্যকর হচ্ছে এবং কোনটি হচ্ছে না সে বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে সহায়তা করবে।
উদাহরণস্বরূপ, উষরমুক্তি বা হোমস্টে পর্যটন প্রকল্পের মতো উদ্যোগের কঠোর মূল্যায়ন ভবিষ্যতে আরও উন্নত করার পথে নির্দেশনা দিতে পারে।
গবেষণার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব—যেমন, বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তনে জীবিকায় কী প্রভাব পড়ছে—এবং সে অনুযায়ী অভিযোজন কৌশলও খুঁজে বের করা যেতে পারে।
জঙ্গল মহল-নির্দিষ্ট শক্তিশালী তথ্যভিত্তি ও ডেটা সংরক্ষণাগার গড়ে তোলা হলে ভবিষ্যৎ কর্মসূচিগুলো আরও উপযোগী ও কার্যকরভাবে পরিকল্পনা করা সম্ভব হবে।
উপসংহারে, জঙ্গল মহলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সতর্ক আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়। এই অঞ্চলে ইতিমধ্যেই অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে—দারিদ্র্যের হার কমছে, অবকাঠামো ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হচ্ছে, এবং সংঘাতের অন্ধকার দিনগুলি আশাব্যঞ্জক বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে বদলে যাচ্ছে।
জঙ্গল মহল এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে ধারাবাহিক প্রতিশ্রুতি থাকলে এটি বঞ্চনার প্রতীক থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের গল্পে রূপান্তরিত হতে পারে।
এখানে অর্জিত শিক্ষা—আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্তি, পরিবেশগত বিষয় ও উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা, এবং ঐতিহাসিক বৈষম্য দূরীকরণ—শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, বরং বহুদূর পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
জঙ্গল মহলকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করা মানে শুধু এখানকার ৫০ লক্ষেরও বেশি বাসিন্দার জীবনমান উন্নত করা নয়, বরং এটি দেখিয়ে দেবে কীভাবে লক্ষ্যভিত্তিক নীতি ও সম্প্রদায়নির্ভর উদ্যোগ ভারতের প্রান্তিক অঞ্চলে গভীরভাবে প্রোথিত দারিদ্র্যকেও জয় করতে পারে।
Sources:
- Mandal, M. et al. (2023). Rural child health in India: the persistent nature of deprivation, undernutrition and the 2030 Agenda – PMC Journal (Purulia case study on child nutrition and poverty)
- Wikipedia – Purulia I (rural poverty and infrastructure data, citing Census and World Bank)
- Wikipedia – Economy of West Bengal (district-wise multidimensional poverty rates from NITI Aayog, 2015–2023)
- Chowdhury & Mete (2018). A Triumph Of Peace Establishment Jangalmahal Area – IJRSR Journal (on Maoist movement and tribal population in Jungle Mahal)
- The Indian Express (Nov 19, 2024). Bengal CM pushes for development in tribal areas (homestays, jobs for tribals in Jungle Mahal)
- The Economic Times (Nov 19, 2016). “Jangal Mahal to be a tourism hub.” (tourism infrastructure plans post-insurgency)
District Statistical Reports & Govt. of WB (2014–2015) – (Purulia literacy, workforce, BRGF listing)
- West Bengal Government & NGO reports (2017–2020) – (Usharmukti watershed project details via PRADAN/BRLF)
A Triumph Of Peace Establishment Jangalmahal Area In West Bengal | IJRSR Journal-UGC guidelines
journal
https://recentscientific.com/triumph-peace-establishment-jangalmahal-area-west-bengal
Jangal Mahal to be a tourism hub – The Economic Times https://economictimes.indiatimes.com/magazines/travel/jangal-mahal-to-be-a-tourism-hub/articleshow/55512422.cms? from=mdr
Purulia I – Wikipedia
https://en.wikipedia.org/wiki/Purulia_I
Economy of West Bengal – Wikipedia
https://en.wikipedia.org/wiki/Economy_of_West_Bengal
Rural child health in India: the persistent nature of deprivation, undernutrition and the 2030 Agenda – PMC
https://pmc.ncbi.nlm.nih.gov/articles/PMC9888739
https://www.pradan.net/wp-content/uploads/2017/02/Jangal-Mahal-Development-Cluster-JMDC.pdf
PRADAN | Strengthening Rural Livelihoods through Livestock …
https://www.instagram.com/p/DJLo_b1sB_U
From giving jobs to helping run homestays, Bengal CM pushes for development in tribal areas | Kolkata News – The Indian Express
In fringes of Bengal’s Jangal Mahals, climate change brings silent …
https://www.downtoearth.org.in/climate-change/in-fringes-of-bengals-jangal-mahals-climate-change-brings-silent-displacement- loss-of-human-lives-biodiversity
Leave a Reply